Amarnath

 

আছাবলের মোগলবাগে একদিন আমরা খোলা আকাশের নীচে বসে আহার করছি, এমন সময় হঠাৎ স্বামীজি ঘোষণা করলেন যে তিনি সমস্ত যাত্রীদের সাথে অমরনাথ-এ যাত্রা করবেন এবং তাঁর কন্যাকে সঙ্গে নেবেন। আমাদের ছোটো দলটার মধ্যে সকলেই এই সংবাদে এতটাই আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন যে সৌভাগ্যবতী সদস্যের যাত্রা সম্পর্কে কোনো আপত্তিই উত্থাপিত হল না, এবং তাদের সম্মতিক্রমে ও এই যাত্রার ভারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীর আনুকূল্যে এই অভিনব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আয়োজন চলতে লাগল।


সেই কয়েক সপ্তাহ মনে হয়েছিল কাশ্মীর তীর্থযাত্রীতে যেন পরিপূর্ণ। শেষ বন্দোবস্তের জন্য আমরা আছাবল পরিত্যাগ করে ইসলামাবাদে আমাদের নৌকায় ফিরে চললাম। সর্বত্র দেখতে পেলাম যাত্রীদল চলেছে। নিস্তব্ধ সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সমস্ত কিছু সম্পন্ন হচ্ছে। দু-তিন হাজার লোক একটি মাঠে ছাউনি ফেলে আবার সূর্যোদয়ের আগেই ওই স্থান ছেড়ে চলে যায়। রান্নার আগুনের ছাই ছাড়া তাদের রাত্রিবাসের আর কোনো চিহ্নই সেখানে দেখা যায় না। তাঁরা সঙ্গে বাজার নিয়ে চলে। প্রত্যেক বিশ্রামস্থলে তাঁবু খাটানো ও দোকান সাজানোর কাজ অসম্ভব ক্ষীপ্রতার সাথে সম্পাদিত হয়। সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করা যেন তাদের স্বভাবসিদ্ধ। ছাউনির এক অংশের মাঝখান দিয়ে চওড়া রাস্তা চলে গিয়েছে এবং সেখানে শুকনো ফল, দুধ ও চাল, ডাল কিনতে পাওয়া যায়। তহশীলদারের তাঁবুটি যার একপাশে স্বামীজির এবং অন্যপাশে আমার তাঁবু সাধারণত এমন স্থানে খাটানো হত সেখানে সন্ধ্যার সময় আগুন জ্বালানোর সুবিধা হত এবং এইভাবেই ওই স্থান স্বামীজির সান্নিধ্যের কারণে সামাজিক (মেলামেশার) কেন্দ্র হয়ে উঠত।


যাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শত শত সাধু ছিলেন। তাদের তাঁবুগুলির রং গেরুয়া, কতকগুলি আবার আকারে এক একটা বড়ো ছাতার মতো। এই সাধু সম্প্রদায়ের উপর স্বামীজির অসীম প্রভাব। তাদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত বিদ্বান তারা প্রত্যেক বিশ্রাম স্থানে স্বামীজিকে ঘিরে থাকতেন। তাঁর তাঁবুর মধ্যে সবসময় ভিড় থাকত। দিনের আলো থাকা পর্যন্ত সাধুরা


কথাবার্তায় মগ্ন থাকতেন। স্বামীজি পরে আমাদের বলেন তাদের কথাবার্তার প্রসঙ্গ ছিল শিব বিষয়ক। আর মাঝে মধ্যে তিনি জোর করে তাদের মনোযোগ বাইরের জগতের প্রতি আকর্ষণ করলে তারা গম্ভীরভাবে তাঁকে ভর্ৎসনা করতেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে বিদেশিরাও মানুষ। তবে স্বদেশ ও বিদেশের মধ্যে পার্থক্য করা হবে কেন? আবার তাঁদের মধ্যে অনেকে মুসলিম ধর্মের প্রতি স্বামীজির প্রেম ও সহানুভূতির অর্থ বুঝতে পারতেন না। যে পরলোক চিন্তা স্বদেশ বিদেশকে অভিন্ন জ্ঞান করত সেই চিন্তাই এই সরল হৃদয়ের ব্যক্তিদের হিন্দু ও মুসলমান যে এক অখণ্ড সত্ত্বার দুটো পরস্পর বিরোধী সত্ত্বা-এই চিন্তায় বাধা দিত। তাদের যুক্তি ছিল ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এরকম বহু


মানুষের রক্তে পাঞ্জাবের মাটি প্লাবিত। অন্তত এখানে যেন স্বামীজি ধর্মীয় গোড়ামির সংকীর্ণতাগুলি মেনে চলেন। এর উত্তরে সেই সময়ের মতো স্বামীজি কতকগুলি আচরণে বিরত থাকেন, যাতে ভ্রাতৃস্থানীয় সাধুদের প্রতি তার প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় এবং তার মূল নীতিগুলি অধিকতর দ্রুততার সাথে গভীরভাবে তাঁদের মনে আঁকা হয়ে যায়। এরূপ আচরণ তাঁর পক্ষে উপযুক্তই হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ভাবি যুগের, কোনোক্রমে পূর্ববর্তী যুগে এসে পড়েছিলেন। যা হোক যখন তিনি তাঁর উয় কথোপকথনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন সেই বর্ণনার অসংলগ্নতা দর্শনে পাশ্চাত্যবাসীরা কৌতুক অনুভব না করে পারেননি। কারণ এই তীর্থযাত্রা সংক্রান্ত বহু কর্মচারী ও ভৃত্য এবং তহশীলদার স্বয়ং ছিলেন মুসলমান এবং যথাসময়ে তীর্থস্থানে পৌঁছিয়ে হিন্দুযাত্রীদের সাথে তাদের গুহায় প্রবেশে যে কোনোরূপ বাধা থাকতে পারে এ কথা স্বপ্নেও কারও মনে ওঠেনি। পরবর্তীতে তহশিলদার কয়েকজন বন্ধুর সাথে স্বামীজির কাছে যথাবিধি শিষ্যত্ব গ্রহণ করবার জন্য উপস্থিত হন, এবং এই বিষয়টি কারও কাছে বিস্ময়কর বা বিষদৃশ্য বলে মনে হয়নি।


ইসলামাবাদ পরিত্যাগ করে আমরা পথের মধ্যে এক জায়গায় তীর্থযাত্রী দলের সাথে মিলিত হই এবং তাদের সঙ্গে সেই রাত্রের মত পাওয়ান নামক জায়গায় তাঁবু ফেলা হয়। পাওয়ান কতকগুলি পুণ্য ঝর্ণার উৎসের জন্য বিখ্যাত। এমনকি এখনও আমি মনে করতে পারি দিঘির পরিষ্কার কালো জলে আলোর প্রতিফলনের ছটা এবং অসংখ্য যাত্রীর ছোটো ছোটো দলে এক মন্দির থেকে অন্য মন্দির-এ গমন।


মেষপালকের গ্রাম পেহেলগামে একাদশী পালন করবার জন্য যাত্রীদল একদিন বিশ্রাম করল। এটি ছিল একটি সুন্দর গিরিখাত- তলদেশের বেশিরভাগ অংশে পাহাড়ি নদীর নুড়ির সংঘর্ষে তৈরি বালুকাময় দ্বীপ। পাহাড়ের ঢাল পাইন গাছের সারিতে ছেয়ে গিয়েছে। সূর্যাস্তের পর সর্বাপেক্ষা উঁচু পর্বতের উপর দিয়ে চাঁদের দেখা মিলেছিল। যদিও এখনও পূর্ণ নয়। এটা ছিল সুইজারল্যান্ড অথবা নরওয়ের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও মনোরম দৃশ্যগুলির মত। এখানে আমরা শেষ জনবসতির চিহ্ন দেখলাম-একটা সেতু, একটা খামারবাড়ি তার সঙ্গে চাষের জমি এবং কতকগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কুটির। যখন আমরা শেষ পথটুকু অতিক্রম করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম তৃণ আচ্ছাদিত গোলাকার পাহাড়ের উপর ফেলে রেখে চললাম অবশিষ্ট যাত্রীগণের তাঁবুগুলি।


অনির্বচনীয় সুন্দর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা তিন হাজার যাত্রী সামনের খোলা উপত্যকায় আরোহণ করতে লাগলাম। প্রথম দিন আমাদের তাঁবু পড়ল পাইন গাছের বনে; পরের দিন তুষাররেখা অতিক্রম করে একটা জমে যাওয়া নদীর ধারে আমরা তাঁবু খাটালাম। সে রাত্রে ছাউনিতে জুনিপার কাঠ দিয়ে বেশ বড়ো আগুন জ্বালানো হল। পরদিন সন্ধ্যায় আরও উপরে ওঠায় ওই বিরল জ্বালানির খোঁজে ভৃত্যদের বহু ক্রোশ ঘুরতে হল। অবশেষে নিয়মিত পথ শেষ হয়ে এল এবং আমরা উঁচু-নীচু পাকদণ্ডি দিয়ে অতি কষ্টে খাড়া পাহাড় বেয়ে অবশেষে যে গিরিসঙ্কটে অমরনাথ গুহা অবস্থিত সেখানে পৌঁছোলাম। চড়াই উত্তরণের সময় আমাদের সামনে ছিল তুষারাবৃত শিখর, সদ্য পড়া সাদা তুষারের পর্দায় আচ্ছাদিত। গুহার ভিতরে সেখানে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না, এমন এক গভীর অংশে মহান তুষার লিঙ্গ বিরাজমান। যে সকল কৃষক মেষপালক ওই তুষার লিঙ্গের প্রথম দর্শনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল তাদের কাছে তা সাক্ষাৎ ভগবানের আবির্ভাব বলেই মনে হয়ে থাকবে।


আসার পথে স্বামীজি তীর্থযাত্রার প্রত্যেকটি বিধিনিয়ম পালন করেছেন। মালা জপ, উপবাস এবং যাত্রার দ্বিতীয় দিনে নুড়ি পাথরের নদীগর্ভগুলি অতিক্রমকালে পরপর পঞ্চনদের বরফ গলা জলে স্নান-সবই তিনি যথা বিধি করেছেন। এবার যখন তিনি গুহার মধ্যে প্রবেশ করেন, তাঁর মনে হয়েছিল মহাদেব যেন সশরীরে তাঁর সামনে প্রত্যক্ষ হলেন। কোলাহল করে অসংখ্য যাত্রীর গুহায় প্রবেশ ও মাথার উপর পায়রার ডানা ঝটপট করে ওড়ার মাঝে স্বামীজি অপরের অলক্ষে ২-৩ বার ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। তারপর পাছে ভাবাবেসে আত্মহারা হয়ে পড়েন এই ভয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ান এবং বাইরে চলে যান। পরে তিনি বলেছিলেন, ওই সংক্ষিপ্ত কয়েক মুহূর্তে তিনি মহাদেবের কাছে ইচ্ছামৃত্যু বর লাভ করেন। সম্ভবত এভাবেই, ছোটোবেলা থেকে যে ধারণা তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল যে পর্বতের মধ্যে কোনো শিব মন্দিরে তাঁর মৃত্যু ঘটবে তা ব্যর্থ হয় অথবা স্বার্থকতা লাভ করে.



গুহার বাইরে অসহায় যাত্রীদের উপর পান্ডাদের অত্যাচার ছিল না। অনাড়ম্বর এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অমরনাথ বিখ্যাত। রাখিবন্ধনের পূর্ণ দিবসেই এই যাত্রার সমাপ্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের হাতে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল লাল এবং হলুদ রঙের রাখি। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা নদীর ধারে কয়েকটা প্রকাণ্ড উঁচু পাথরের উপর বসে আহার সম্পন্ন করলাম। পরে তাঁবুতে ফিরে এলাম।


স্বামীজি স্থান মাহাত্ম্যে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বোধ


হয়েছিল এই রকম সুন্দর স্থানে এর আগে তিনি আর কখনও আসেননি। বহুক্ষণ তিনি নীরবে বসেছিলেন। তারপর স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে বললেন, "আমি বেশ কল্পনা করতে পারি কীভাবে এই গুহাটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। গ্রীষ্মকালের কোনো একদিন একদল মেষপালক তাদের নিরুদ্দিষ্ট মেষগুলির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পড়ে। তারপর উপত্যকায় অবস্থিত তাদের ঘরে ফিরে বর্ণনা করে কীভাবে তারা হঠাৎ মহাদেবের দর্শন লাভ করে।


অন্তত আমার প্রভু নিজে এইরকম একটি গল্পকে সত্য বলে মনে করেন। তুষার লিঙ্গের পবিত্রতা ও শুভ্রতা তাকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করেছিল। গুহাটি তাঁর কাছে কৈলাসের রহস্য উন্মোচন করে। কীভাবে তিনি একটা পার্বত্য গৃহায় প্রবেশ করে সাক্ষাৎ ভগবানকে প্রত্যক্ষ করেন তার স্মৃতি তিনি সারাজীবন হৃদয়ে লালন করেছেন।


Post a Comment

0 Comments